অসমীয়া   বাংলা   बोड़ो   डोगरी   ગુજરાતી   ಕನ್ನಡ   كأشُر   कोंकणी   संथाली   মনিপুরি   नेपाली   ଓରିୟା   ਪੰਜਾਬੀ   संस्कृत   தமிழ்  తెలుగు   ردو

ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র কাঠামো

গোড়ার কথা

ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র গত ছয় দশকে বহু পরিবর্তনের মধ্য‌ে দিয়ে গিয়েছে। এখানে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করব সেই অভিজ্ঞতার চুম্বক বৈশিষ্ট্য‌গুলি -- দ্বিধা, ভুল, ব্য‌র্থতা এবং একই সঙ্গে উদ্ভাবন, উদ্বৃত্ত ও সাফল্য‌। গত দু’ দশকে এই অভিজ্ঞতায় সংযোজিত হয়েছে এক নতুন অধ্য‌ায় : যুক্তরাষ্ট্রীয় জোটের যুগ।

এই অভিজ্ঞতার সূচনায় প্রথাগত বিবেচনার বহু নির্দেশ সরিয়ে রাখতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিশুদ্ধতাবাদীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছেন। ঔপনিবেশিক একমুখী রাষ্ট্রের উত্তরাধিকার অগ্রাহ্য‌ করে প্রথাবর্হিভুত পথে খুঁজে বেড়াতে হয়েছে নানা অভূতপূর্ব সমস্য‌ার সমাধানসূত্র। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য‌ অপিরহার্য অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ণ না করে ব্য‌বস্থাপনের স্তরে কতটা বৈচিত্র অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব, এই সময়েই তা উদ্ভাবন করতে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কঠোর। তবে বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক বিকাশের নব্য‌-উদার যুগে রাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণের সঙ্গে এক এক করে দেখলে তা অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে।

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত নাগরিকদের অর্থপূর্ণ অধিকার সুনিশ্চিত করার মধ্য‌ দিয়ে ক্রমাগত নিজেকে উন্নীত করার প্রয়াস চালিয়ে গেছে। এর টিকে থাকা এবং বিকশিত হতে পারার মূল কারণ হল এর যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো।

যথাযথ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণ

বিশৃঙ্খল ঔপনিবেশকতার অবসানে নবীন রাষ্ট্রের কাছে সব চেয়ে জরুরি ছিল সংহতি সাধন। গণপরিষদে পুরোধা ব্য‌ক্তিত্বরা তাঁদের মূল উদ্দেশ্য‌ নির্বাচনে ভুল করেননি। আদর্শ ও দূরদৃষ্টির সমন্বয়ে তাঁরা এক শক্তপোক্ত মজবুত গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।

তৎকালীন প্রেক্ষাপট এবং সেই সময়কার কিছু দুঃখজনক ঘটনার জেরে ভারতকে একবাদী দেশ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য‌ যথেষ্ট চাপ ছিল। প্রবল বিতর্কের পর গণপরিষদ ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করে। সংখ্য‌ালঘুদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে ব্য‌বস্থা করা হয় রক্ষাকবচের।

দেশ ভাগের জেরে নজিরবিহীন হিংসা, ভীতি এবং ছিন্নমূল মানুষের অসহায়তায় বিচলিত গণপরিষদ স্বাভাবিক ভাবেই নতুন জাতির একতা ও অখণ্ডতা রক্ষায় মনোনিবেশ করে। অতিরিক্ত যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদ, কেন্দ্রাতিগ ও বিভাজনকামী শক্তিকে বর্জন করা হয়।

ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় মডেল

ভারতে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গ্রহণ করা হয়েছিল তা সব যুক্তরাষ্ট্রীয় মডেলের চেয়ে আলাদা ছিল। সময়ের চাহিদা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজের প্রয়োজনীয়তার দিকে নজর রেখে গণপরিষদ একটি যথাযথ ব্য‌বস্থাপনা গড়ে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের যুক্তি মেনে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সূচনা হয়, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্য‌বস্থাপনাকে পূর্ণতা দেয়।

সেই সময়কার অন্য‌ান্য‌ মডেলের সঙ্গে সাদৃ্শ্য‌ না থাকায় এবং নির্দিষ্ট বিধিনিয়ম ও মাপকাঠির অভাবে নতুন এই ব্য‌বস্থাপনাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় আখ্য‌া দেওয়া যায় কিনা, তা নিয়ে গবেষকরা দ্বিধায় পড়েন। তাই একে ‘অর্ধ যুক্তরাষ্ট্রীয়’ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই ব্য‌াখ্য‌া আজ আর গ্রহণযোগ্য‌ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসমূহের শিকড় ভারতবর্ষের মাটিতে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে। ভারতের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি যুক্তরাষ্ট্রীয় ঘরানার সংকর উপাদান হিসাবে চিহ্নিত। স্বনিয়ন্ত্রণ ও সর্বজনগ্রাহ্য‌ বিধিনিয়মের প্রথা বহির্ভূত সমন্বয় ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু টিকিয়েই রাখেনি তাদের বৈচিত্রকে বিকশিত হতে সাহায্য‌ করেছে। গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ভারতকে সযত্নে এই মূল্য‌বান উত্তরাধিকার রক্ষা করতে হবে।

রাজ্য‌ পুনর্গঠন প্রক্রিয়া

ভাষাগত পরিচয়ের ভিত্তিতে অঞ্চল গঠনের বিষয়টিকে গণপরিষদ বিশেষ গুরুত্ব দেয়। জাতীয় আন্দোলনের সময় প্রথম এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র স্থির ও জনপ্রিয়তা অর্জনের ভ্রান্ত পথে ঘুরে এর রূপায়ণ বিলম্বিত হয়।

সংবিধানে রাজ্য‌ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার নমনীয়তা দেখে অনেকেই আশ্চর্য হয়েছিলেন। বাস্তবে এর প্রয়োগ কী ভাবে ঘটানো সম্ভব, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁরা। এর উত্তর পেতে গেলে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার পুনর্মূল্য‌ায়ন করতে হবে। তবে এই প্রক্রিয়ার রূপায়ণ যে কতটা কঠিন, সংঘর্ষ ও হিংসার মধ্য‌ দিয়ে তেলঙ্গানার জন্ম তারই প্রমাণ।

স্বাধীনতার পর প্রথম দু’ দশকের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করা যায় আত্মপরিচয় ও অভাবের রাজনীতির মিশ্রণ হিসাবে। আত্মপরিচয়, ভাষা ও সীমারেখা নিয়ে উত্তেজনা এই সময়ের বৈশিষ্ট্য‌।

কেন্দ্র ও রাজ্য‌ের ক্ষমতা বিভাজন নিয়ে বিতর্ক ভারতের রাজনীতিতে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে। শেখ আবদুল্লা, জ্য‌োতি বসুর মতো শ্রদ্ধেয় মুখ্য‌মন্ত্রীরা নানা সময় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কাঠামো

নব্য‌ উদার চিন্তাধারা অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরোধী হলেও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কাঠামোর অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা প্রমাণিত। নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনার অর্থ অনিয়ন্ত্রিত বিকাশ নয়। তাই পুরনো রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির স্থান নিয়েছে নতুন স্বাধীন নিয়ন্ত্রক ব্য‌বস্থা। তবে এই স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে যে গণতান্ত্রিক ভাবে দায়বদ্ধ করে তোলা হয়নি, তা অন্য‌ বিষয়।

ম্য‌াক্রো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হাতে। কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনার ফলে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণের সুযোগ আরও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়নি। বরং আরও নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়েছে। ভারতের সামাজিক বৈচিত্রের প্রকৃতি ও ব্য‌াপকতার সাপেক্ষে মেলবন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখতে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র অপরিহার্য ছিল।

ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উন্নয়নের প্রথম পর্বে প্রাতিষ্ঠানিক সভাগুলির চমকপ্রদ বিকাশ লক্ষ করা যায়। সহযোগিতা ও সমন্বয়ের কেন্দ্র হিসাবে এগুলি কাজ করে। একই রাজনৈতিক দল একক ভাবে ক্ষমতায় থাকায় চ্য‌ালেঞ্জের মোকাবিলা করা আরও সহজ হয়। রাজ্য‌গুলির স্বশাসনের পক্ষে গলা ফাটানো অত্য‌ন্ত গোঁড়া সমর্থকরাও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কাঠামোকে চ্য‌ালেঞ্জ জানানোর কথা ভাবেননি। তাঁরা কেন্দ্রীয় কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে রাজ্য‌ের হাতে আরও ক্ষমতা দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন।

এখানে বলা দরকার সাবেক কাঠামোয় কাজের অগ্রগতির জন্য‌ রাজ্য‌ের হাতে যথেষ্ট আইনি ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় সংবিধানের কেবল আক্ষরিক অর্থ ধরলে অবশ্য‌ বিষয়টি স্পষ্ট হবে না। সেখানে বহু ক্ষেত্রেই রাজ্য‌ের বিচার্য ক্ষেত্রগুলির উপর কেন্দ্রকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে রাজ্য‌গুলিকে কেন্দ্রীয় প্রকল্প ও জাতীয় মিশনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। তৃতীয় তালিকার ২০-তম বিষয় হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। এটাই প্রথম পর্বের পরিকল্পিত উন্নয়নের মডেলের সাংবিধানিক ভিত্তি।

ক্ষমতা ও দায়িত্ব ভাগাভাগির ক্ষেত্রে নতুন কিছু বিষয় এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। আগেকার সময়ে যে বিষয়গুলি নিয়ে সংস্কারের দাবি তোলা হত, তা এখন খানিকটা চাপা পড়ে গিয়েছে।

ক্ষমতা ও দায়িত্বের বণ্টন নিয়ে বিবাদ

ভূমিকা

প্রয়োগমুখী যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্য‌বস্থার আধুনিক রূপের জন্ম কিন্তু আমেরিকায়। পরে সোইয়েত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সময় তা একটি বিশিষ্ট চেহারা নেয় যা গুণগতভাবে পশ্চিমী অভিজ্ঞতার থেকে ভিন্ন ধরনের।

যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্য‌বস্থায় ক্ষমতা ও দায়িত্বের বণ্টন নিয়ে বিবাদ সাধারণ ঘটনা। তবে এই দুইয়ের মধ্য‌ে সামঞ্জস্য‌ের অভাব খুব বেশি হলে মারাত্মক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।

রাজ্য‌গুলির সঙ্গে আলোচনা না করে প্রায়শই কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কর্ম পরিকল্পনা স্থির করে ফেলে তার পর কেন্দ্র রাজ্য‌গুলির মতামত চায়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে না হয়ে পরে ঐকমত্য‌ স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাজ্য‌গুলির অধিকার সুনিশ্চিত করতে হলে শুধু আলোচনা করলেই হবে না, প্রয়োজনে আরও সক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নিতে হবে। রাজ্য‌গুলির মধ্য‌ে যে অসাম্য‌ রয়েছে, তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে এমন এক রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত, যেখানে অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ না করে বা অভিন্নতাকে চাপিয়ে না দিয়ে এই বৈচিত্রকে রক্ষা করা সম্ভব।

অসামঞ্জস্য‌পূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ধারণায় আদানপ্রদান ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র জড়িত। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য‌ যত বেশি করে সামনে আসে, ততই এ সংক্রান্ত বিধিসম্মত ব্য‌বস্থাপনার দাবি জোরালো হয়। ভারতের রাজ্য‌গুলির মধ্য‌ে, এমনকী একই রাজ্য‌ের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্য‌েকার অসাম্য‌ অসন্তোষ ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে। বিশেষ মর্যাদা দান, বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা ও সহায়তার মতো পদক্ষেপ সমস্য‌ার সমাধানে অনেকটা সহায়ক হয়।

ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সমস্য‌ার সমাধানেও বিশেষ মর্যাদা দানের সংস্থানটি ব্য‌বহার করা হয়। সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৭১ ধারা প্রয়োগ এর নিদর্শন।

রাজ্য‌ের আওতায় স্বশাসনিক কাঠামো, স্বশাসিত জেলা পরিষদ প্রভৃতির ফলাফল মিশ্র। এর জেরে কিছু ক্ষেত্রে বিক্ষোভ প্রশমিত হয়, আবার কিছু ক্ষেত্রে পৃথক রাজ্য‌ের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। তবে সার্বিক ভাবে দেখতে গেলে আঞ্চলিক স্বশাসন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করার পরিবর্তে তাকে আরও দৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপন করেছে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই ধরনের স্বশাসন গণতান্ত্রিক চেতনা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।

আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা : নতুন মন্ত্র

উদারীকরণ ও নিয়ন্ত্রণ হ্রাস রাষ্ট্রকে কি আরও শক্তিশালী করে? নাকি দুর্বল করে তোলে? পরিবর্তিত এই দর্শন কি রাষ্ট্রশাসন ব্য‌বস্থা ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে? ‘রাষ্ট্রের অধিকারের’ নতুন ভাবনা কি রাজনৈতিক স্বশাসন থেকে অর্থনৈতিক শক্তিমুখী? এই প্রশ্নগুলির উত্তর এখনও খুব স্পষ্ট নয়।

ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে প্রথমেই রাজনৈতিক সংহতি স্থাপনের লক্ষ্য‌ নেওয়া হয়েছিল। অভিন্ন মুদ্রা ব্য‌বস্থা, কেন্দ্রীয় ব্য‌াঙ্ক এবং ম্য‌াক্রো অর্থনৈতিক বিষয়গুলির উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় সাধারণ বাজারগুলি গড়ে তোলাকে ভাবা হয়েছিল অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ। কিন্তু অর্থনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তায় ক্রমশ বেড়ে চলা অসাম্য‌ এই সংহতি সাধনের পথে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। রাজ্য‌গুলিকে ক্ষমতার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়। আন্তঃরাজ্য‌ শুল্ক থেকে উপার্জিত অর্থের ভাগ যাতে তারা কেন্দ্রকে দেয়, সে জন্য‌ জটিল ও দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

নয়ের দশকের গোড়ায় উদারীকরণ ও বাজারশক্তির ক্রমবর্ধমান ভূমিকায় ভারতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ থেকে জন্ম নেয় নতুন বৈপরীত্য‌ ও দলভেদ। আগে রাষ্ট্রই উদ্য‌োগী হয়ে এ ধরনের অসন্তোষ মিটিয়ে দিত। বাজারের আওতার বাইরে থেকে যাওয়া মানুষজনকে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের নীতি ও প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হত।

আয়গত অসাম্য‌ের পাশাপাশি বিপুল আঞ্চলিক অসাম্য‌ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য‌। এ ক্ষেত্রেও সমস্য‌ার সমাধানে রাষ্ট্র আগে সক্রিয় ভূমিকা নিত। বর্তমান পরিস্থিতি মূলত দু’টি উপাদানের সংমিশ্রণের ফল। অর্থনৈতিক উদারীকরণ সংস্কার কর্মসূচি এবং দলীয় ব্য‌বস্থার যুক্তরাষ্ট্রীয়করণ। ক্রমশ বেড়ে চলা অসাম্য‌ের সমস্য‌াটিও একই রকমের জটিল। এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য‌কে রাষ্ট্র তার নতুন ভূমিকায় কী ভাবে সামলাবে, সেটাই বিতর্কের মূল বিষয়।

প্রস্তুতি ও সামর্থ্য‌ে ফারাক থাকলেও রাজ্য‌গুলি এখন লগ্নি টানতে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এর জেরে জন্ম হয়েছে প্রতিযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার, যদিও রাজ্য‌গুলিকে এক সমতলে নিয়ে আসার কাজ এখনও বাকি।

বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্য‌ে রাজ্য‌গুলির এই প্রতিযোগিতা দু’টি দিক থেকে দেখা যেতে পারে। এক দিকে সুশাসন ও সুচারু আর্থিক ব্য‌বস্থাপনা সুনিশ্চিত করতে রাজ্য‌গুলির উপর চাপ বাড়ছে। অন্য‌ দিকে বেশ কিছু সংস্কার প্রক্রিয়ার নেতিবাচক প্রভাব যে তাদের ভোট বাক্সের উপর পড়তে পারে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে সজাগ থাকতে হচ্ছে।

নয়ের দশক এক মাইলফলক

ভারতীয় রাষ্ট্র ব্য‌বস্থার রূপান্তরের ক্ষেত্রে নয়ের দশক এক মাইলফলক। এই সময় থেকেই রাজনৈতিক ব্য‌বস্থা আরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রীয় হয়ে উঠতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রীয় জোট সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের নতুন নতুন রাস্তা খুলে দেয়। রাজ্য‌ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলি জাতীয় নীতি প্রণয়ন এবং কেন্দ্র-রাজ্য‌ সম্পর্কের উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্য‌মে যা সম্ভব হত না, যুক্তরাষ্ট্রীয় জোট আঞ্চলিক শক্তিগুলির কাছে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। এই রূপান্তরের নেপথ্য‌ে দু’টি মূল চালিকাশক্তি রয়েছে। প্রথমত, উদারীকরণের জেরে রাষ্ট্রশাসন ব্য‌বস্থায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। অর্থনৈতিক সংস্কার রাজ্য‌গুলির জন্য‌ নতুন ভূমিকা ও দায়িত্ব নির্দিষ্ট করেছে। দ্বিতীয়ত, তার নিজস্ব ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যুক্তি মিশ্রণ’ নিয়ে দলব্য‌বস্থার যুক্তরাষ্ট্রীয়করণ এক নতুন গতির সঞ্চার করেছে।

রাজ্য‌ভিত্তিক দলগুলির মাধ্য‌মে স্থানীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার উজ্জীবন এবং অন্য‌তর প্রেক্ষিতে জাতীয় সংহতি -- এই দুইয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। বহুস্তরীয় এই সম্পর্কের জেরে ক্ষমতা ভাগাভাগির যে তত্ত্বের জন্ম -- সমগ্র ব্য‌বস্থাকে এক সূত্রে গেঁথে রাখার ক্ষেত্রে তা এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

এই সময়ের আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, স্থানীয় স্বশাসন প্রতিষ্ঠানগুলিকে ক্ষমতা প্রদান। ৭৩তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্য‌মে একে আইনি রূপ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তৃতীয় স্তর হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে এটি।

কিন্তু তাই বলে আমরা যে বহুস্তরীয় যুক্তরাষ্ট্রীয়তার স্বর্গে বাস করছি অথবা অদূর ভবিষ্যতে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। রাজ্য‌স্তর, রাজনৈতিক বৃত্ত ও আমলাতন্ত্রের মধ্য‌ে থাকা বেশ কিছু প্রভাবশালী মহল নিজেদের কায়েমি স্বার্থে এই বিকেন্দ্রীকরণের বিরোধিতা করছে।

পঞ্চায়েত ব্য‌বস্থার ক্রমবিকাশ এবং নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে যৌথ কর্মপ্রয়াস যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্য‌বস্থার এক উল্লেখযোগ্য‌ ঘটনা। এর ফলে যে সচেতনতা ও চাপের সৃষ্টি হয়েছে, তা ভবিষ্য‌তে আরও সংহত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আরও পরিবর্তন আনবে।

নতুন সহস্রাব্দের চ্য‌ালেঞ্জ

নতুন সহস্রাব্দে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র কী কী চ্য‌ালেঞ্জের সম্মুখীন, এ বার তা দেখা যাক। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতা ও প্রভাব এখন কেন্দ্র থেকে রাজ্য‌গুলির রাজধানীতে এবং তার পর উপঅঞ্চল, জেলা ও পঞ্চায়েতের মতো তৃণমূল স্তরের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।’ এই পর্যবেক্ষণ কি সত্য‌? এর স্বপক্ষে আঞ্চলিক ও জাতপাতভিত্তিক দলগুলির উল্লেখযোগ্য‌ সাফল্য‌ এবং দেশের বহু জায়গায় পৃথক রাজ্য‌ গঠনের দাবি ওঠার বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা সমসাময়িক প্রবণতার সাপেক্ষে এই পর্যবেক্ষণকে একটু বিশ্লেষণের চেষ্টা করি।

ভারতের মতো বহুমাত্রিক সংস্কৃতির দেশে সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণতা বেড়ে চলার প্রবণতা অত্য‌ন্ত বিপজ্জনক। প্রধানত দু’টি ক্ষেত্র এখনও অমীমাংসিত।

প্রথমত, আত্মপরিচয় সংক্রান্ত প্রশ্ন : দ্বিতীয় রাজ্য‌ পুনর্গঠন কমিশন স্থাপন এবং আন্তঃসীমা পুনর্বিন্য‌াসের দাবি ইতিমধ্য‌েই উঠেছে। গঠিত হয়েছে তেলঙ্গানা রাজ্য‌। বিদর্ভ রাজ্য‌ গঠন এবং উত্তরপ্রদেশের পুনর্গঠন সহ বিভিন্ন ইস্য‌ু এখনও সজীব। দ্বিতীয়ত, সম্পদ সংক্রান্ত অস্থিরতা : জলসম্পদ, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জলবণ্টন সমস্য‌া (কাবেরী, নর্মদা) এবং পিছিয়ে পড়া রাজ্য‌গুলির জন্য‌ অঙ্ক নিয়ে বিবাদ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃহত্তর স্বশাসন এবং সম্পদের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ দাবি।

এ ছাড়া অর্থনৈতিক সম্পদের পুনর্বণ্টন এবং আর্থিক ব্য‌বস্থাপনা ঢেলে সাজার বিষয়টিও নতুন সহস্রাব্দে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারে স্থান পেতে পারে। কর বাবদ আয়ের সিংহভাগ কেন্দ্র নিয়ে নেওয়ায় এ সংক্রান্ত ব্য‌বস্থাপনার সংস্কারের দাবিও উঠেছে।

কেন্দ্রে জোট সরকার গঠন ও আঞ্চলিক দলগুলির ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রতিফলন পড়ছে কেন্দ্র-রাজ্য‌ সম্পর্কেও। যুক্তরাষ্ট্রীয় জোটের মাধ্য‌মে আঞ্চলিক দলগুলি জাতীয় স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে, যা অধুনালু্প্ত যোজনা কমিশন, জাতীয় উন্নয়ন পরিষদ বা আন্তঃরাজ্য‌ পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্য‌ দিয়ে এর আগে কখনও পাওয়া যায়নি।

এর পাশাপাশি জাতীয় নীতি প্রণয়নে রাজ্য‌গুলির অংশগ্রহণ আরও বাড়ানোর নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবন এবং বিদ্য‌ুৎ, সড়ক, মৌলিক নাগরিক পরিষেবার মতো মূলগত পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে গৃহীত প্রকল্পগুলির কার্যকর রূপায়ণে তাদের উদ্বুদ্ধ করে তোলা আর এক চ্য‌ালেঞ্জ। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এই লক্ষ্য‌ অর্জনে কিছুটা সফল হলেও কার্যকর প্রতিষ্ঠানিক ব্য‌বস্থাপনার বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না।

সূত্র : যোজনা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020



© C–DAC.All content appearing on the vikaspedia portal is through collaborative effort of vikaspedia and its partners.We encourage you to use and share the content in a respectful and fair manner. Please leave all source links intact and adhere to applicable copyright and intellectual property guidelines and laws.
English to Hindi Transliterate