এটা মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। হঠাৎ করে মস্তিষ্কে যে কোষগুলো আছে, সেখান থেকে বিদ্যুতের মতো চমকাতে থাকে। সেটা অস্বাভাবিক এবং বেশি পরিমাণে হয়। এর একটি প্রকাশ শরীরে হতে থাকে। যেমন হঠাৎ করে খিঁচুনি হয় বা কাঁপুনি হতে থাকে। অথবা হাত পা শক্ত হয়ে যায়। চোখ উল্টে যায়, মুখ একদিকে বাঁকা হয়ে যায়। অথবা এমনও হতে পারে, হঠাৎ করে সে অন্যমনস্ক হয়ে গেল, হাতে কোনো কিছু ছিল- সেটা পড়ে গেল। মুখ দিয়ে ফেনার মতো আসতে থাকল। এমনকি পায়খানা-প্রস্রাবও হয়ে যেতে পারে।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মস্তিষ্কের কোনো একটা সংক্রমণ হলে; সেটার জটিলতা হিসেবে এটি প্রকাশ পায়। অথবা দেখা যায় বাচ্চাদের জন্মের সময় মাথায় কোনো আঘাত পেলে, তখন অক্সিজেন পেতে দেরি হলে মস্তিষ্কের সমস্যা হয়। অথবা যদি বাচ্চা কম ওজনের হয় বা যে তারিখে জন্মের সময় ছিল তার আগেই যদি জন্ম হয়ে যায়, তাদেরও কখনো কখনো এপিলেপসি হতে দেখা যায়। আরো কিছু সমস্যা দেখা দেয় যেমন, ইলেকট্রোলাইট যেগুলো আছে, হঠাৎ করে সোডিয়াম, পটাশিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হলে গ্লুকোজ কমে যায়, তারই জটিলতা হিসেবে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। অথবা মাথায় কোনো আঘাত পেলে এই সমস্যা হতে পারে। মস্তিষ্কে টিউমার হলে এই সমস্যা হতে পারে। আসলে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো কারণই জানা যায় না। কিছুটা বংশগত কারণেও হতে পারে।
প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় হতে পারে। এ ছাড়া শিশুরা যারা এই সমস্যায় ভুগছে, তারাও একসময় প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়।
নিরাপদ জায়গায় তাকে রাখতে হবে। আরামদায়ক অবস্থায় শুইয়ে দিতে হবে। কাত করে শুইয়ে দিতে হবে বা উপুড় করে শুইয়ে দিতে হবে। দুই হাত দুই দিকে দিয়ে মাথাটাকে একদিকে দিয়ে শুইয়ে দিতে হবে, যাতে মুখের সমস্ত লালা বাইরে পড়ে যেতে পারে। কাছাকাছি আগুন, গরম জল, ধারালো কিছু থাকলে এগুলো সরিয়ে নিতে হবে, তখন হাত-পা ছোড়াছুড়ির ফলে এগুলো যাতে কোনো ক্ষতি করতে না পারে। মুখে কিছু দেওয়া যাবে না এই সময়টায়। অনেক সময় তাদের দাঁত বা জিহ্ববা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তখন আমরা মুখে চামচ দিই, জল দিই- এগুলো এই সময় দেওয়া যাবে না। অনেক সময় চেপে ধরি যেন খিঁচুনি না হয়, এগুলো করা যাবে না। এগুলোতে আরো তাদের ক্ষতি হয়। পাশাপাশি হৈ চৈ না করা উচিত। যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
আমরা প্রথমত পায়খানার রাস্তায় একটি ইনজেকশন দিই। এটা দিলে তৎক্ষণাৎ খিঁচুনি কমে যায়। এটাতে না কমলে তখন শিরায় আইভি ইনজেকশন দিই। বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশন দিয়ে প্রথমে আমরা খিঁচুনিটা কমানোর চেষ্টা করি। তারপর যখন খিঁচুনিটা কমে যায়, তখন আমরা ইতিহাস খতিয়ে দেখি-কেন এটা হলো খুঁজে বের করে কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা করি। এর পাশাপাশি হাসপাতালে যখন ভর্তির সময়, তখন খেয়াল রাখতে হবে তার পালস, রক্তচাপ যেন ঠিক থাকে, শ্বাসপ্রশ্বাস যেন ঠিকভাবে চলাচল করে।
এটি মস্তিষ্কের একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। স্বভাবতই এটি মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা তৈরি করতে পারে। মস্তিষ্কের বিকাশ সুন্দরভাবে হয় না। কথা বলতে সমস্যা হয়। তাদের বুদ্ধির বিকাশে সমস্যা হয়। কথা তৈরিতে সমস্যা হতে পারে।
সাধারণত শেষ যেদিন খিঁচুনি হলো এই সময় থেকে তাকে দুই থেকে তিন বছর ওষুধ খেতে হবে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে যদি বড় কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে ওই সমস্যাটা থেকেই যাবে। যেমন কোনো একটা স্ট্রোকে পড়তে পারে। বাচ্চাদেরও স্ট্রোক হয়। বা কোনো একটি ট্রমা বা টিউমার থেকে এই সমস্যা হলো, তখন মস্তিষ্কের সমস্যা থেকেই যাবে। এর ফলে সব সময় তার খিঁচুনির সমস্যা থাকবে। কিছু কিছু মারাত্মক ধরনের এপিলেপসি আছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে সারা জীবনই ওষুধ খেতে হয়। সাধারণত দুই থেকে তিন বছরের ওষুধ দিয়ে থাকি, যদি খিঁচুনি না হয়। এরপর ধীরে ধীরে ওষুধ বন্ধ করে দিই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সারা জীবনই খেতে হয়। এটা চিকিৎসকই সিদ্ধান্ত নেবেন যে কতদিন খেতে হবে।
সমাজে বোঝাতে হবে এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ না বা মানসিক রোগ না। এটি এমনও না যে পাগল হয়ে গেছে। এর নিরামায়যোগ্য চিকিৎসা আছে। এ পৃথিবীতে অনেক বড় বড় ব্যক্তিদের মধ্যেও এই রোগ ছিল। যেমন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, নেপোলিয়ান বোনাপোর্ট, জুলিয়াস সিজার- এদের মৃগীরোগ ছিল। আর দশটা সাধারণ রোগের মতো এটিও একটি রোগ এবং এর চিকিৎসা রয়েছে। এটি নিয়েও বেড়ে ওঠা যায়, সব কিছু করা যায়।
মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি রোগ। আমরা যে কাজ করি, প্রতিটি কাজের জন্য মস্তিষ্ক থেকে একটি সিগন্যাল আসে। সে জন্য কাজগুলো আমরা করতে পারি। তবে মৃগীরোগে অযাচিত সংকেত আসে। সে জন্য শরীরের কোনো একটি অংশ বা সারা শরীরে একসঙ্গে কম্পন অনুভূত হয়, ঝাঁকি দেয়। এবং এ রকম হয় যে রোগী মাটিতে পড়ে যায়, খিঁচুনি হয়। এর পর অনেক সময় জিহ্বা কেটে যায়, প্রস্রাব হয়ে যায়। এই উপসর্গগুলো থাকলে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই আপনি বলতে পারেন, লোকটি মৃগীরোগে ভুগছে।
যেগুলো শিশু বয়সে হয়, এগুলোর মধ্যে মস্তিষ্কের ছবি তোলার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, যেমন—সিটি স্ক্যান অব দ্য ব্রেইন, এমআরআই। উন্নত মানের ইমেজিং পদ্ধতি রয়েছে, এতে কোনো কিছু পাওয়া যায় না। সেগুলোকে প্রাইমারি ইপিলিপসি বলে বা কারণবিহীন মৃগীরোগ বলা হয়।
আর ৪০ বা এর বেশি বয়সের মানুষের হঠাৎ খিঁচুনি হলো সেটার নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। তার মস্তিষ্কে টিউমার থাকতে পারে। হয়তো তার স্ট্রোক হয়েছে, তার হঠাৎ করে খিঁচুনি হলো। একে সেকেন্ডারি ইপিলিপসি বা মৃগীরোগ বলে। তার একটি নির্দিষ্ট কারণ আছে এবং এটি সাময়িক। যে কারণের জন্য হচ্ছে, সেটি সংশোধন করার পর তার খিঁচুনি বন্ধ হয়ে যাবে।
মৃগীরোগ হলে খিঁচুনি হয়, সারা শরীর বা একাংশ অজ্ঞান হয়ে যায় বা মাটিতে পড়ে যায়। এ ছাড়া মৃগীরোগের বহু উপসর্গ আছে, যেমন—কিছু কিছু মা এসে বলেন, আমার শিশুটি স্কুলে ভালো ছাত্র ছিল, হঠাৎ হঠাৎ সে আনমনা হয়ে থাকে। কেউ ডাকলে তখন সাড়া দেয় না। শিশুটি স্কুলে ভালো ছিল। তবে দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এটি একটি সাধারণ ব্যাপার। তবে এটিও মৃগীরোগের একটি লক্ষণ। যদিও সে মাটিতে পড়ে যায় না, ওই সময় প্রস্রাব হয়ে যায় না। তবুও এটি মৃগীরোগ।
এটি শিশুদের হয় এবং একে ইংরেজিতে এবসেন্স সিজার বলে। যেমন—কতক্ষণ তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক নেই। তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই রকম। এতে তার স্কুলের কার্যক্রম খারাপ হয়ে যায়। এটি বাসায় থাকলেও হতে পারে। এটি একটি উপসর্গ যে, আপনার দিনে অসংখ্যবার হচ্ছে। ২০ বার বা ৩০ বার হচ্ছে। যাঁরা শিক্ষিত বা সচেতন মা, তারা ঠিকভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেন এবং চিকিৎসকের কাছে যান। এটা ইপিলিপসি এবং এক ধরনের মৃগীরোগ।
এসব বাচ্চার চিকিৎসা যথাসময়ে না দিলে তার মেধার বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। স্কুলের যে কার্যক্রম, সেটি খারাপ হতে থাকে। যে ধরনের মৃগীই হোক, একটি অনুপস্থিতি ভাব বা আনমোনা থাকা বা মাটিতে পড়ে যায়। এসব ঘটনা ঘটার ফলে তাদের মস্তিষ্কের কোষের কিছু ক্ষতি হয়। চিকিৎসা ছাড়া থাকলে মেধা এবং বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পায়।
যেসব রোগীর উপসর্গগুলো স্পষ্ট, সাধারণ মানুষ একেই মৃগীরোগ বলে। তবে আনমনা যেটি, সেটিকে সাধারণ মৃগী রোগ বলি না। আপনি জানেন, বাংলাদেশে মৃগীরোগ সম্বন্ধে অনেক কুসংস্কার আছে। মৃগীরোগ আছে—এ কথাটা অভিভাবকরা প্রকাশ করতে চান না। এ জন্য আমরা অনেক সময় বলি, এলাকায় গিয়ে তার মৃগীরোগ হয়েছে বলা দরকার কি, ইপলিপসি বলুন। এ ক্ষেত্রে ইইজি পরীক্ষাটি খুবই সহায়ক হয়ে থাকে। এই রোগের বহুবিধ ওষুধ এখন রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ওষুধ বেরিয়েছে। ২০ থেকে ৩০ বছর আগে স্বল্প সংখ্যক ওষুধ ছিল। চিকিৎসা একটু দুরূহ ছিল। এখন চাইলেই এই সুবিধা যেকোনো রোগী নিতে পারেন।
এই চিকিৎসা খুবই দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল। এ কারণেই রোগীর আত্মীয়স্বজন একটু অনীহা প্রকাশ করেন। আরেকটি বিষয় হলো, চিকিৎসা শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যে উপসর্গগুলো চলে যায় না। তাই রোগী এবং রোগীর অভিভাবককে বোঝানো প্রয়োজন। এবং চিকিৎসা গ্রহণের পর উদ্বুদ্ধকরণ খুবই প্রয়োজন।
তাদের আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি বিভিন্ন রোগের মেয়াদ ভিন্ন। যেমন ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা তিন দিন বা পাঁচ দিন, টাইফয়েড রোগের চিকিৎসা ১৪ দিন, টিউবার কোলোসিসের চিকিৎসা ছয় মান বা নয় মাস। তবে মৃগীরোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সারা জীবনও প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসা চালু করার পর যদি টানা তিন বছর কোনো উপসর্গ না হয়, তখন ধীরে ধীরে ওষুধ বন্ধ করা যায়।
ওষুধ শুরু করার পরই রোগটি বন্ধ হয়ে যায় না। ওষুধ শুরু করার পর এর মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। আরেকটি ওষুধ যোগ করতে হতে পারে। তিন বা ততোধিক ওষুধ শুরু করতে হতে পারে। এবং সুস্থতার খাতিরে এটি অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
সূত্র: বিকাশপিডিয়া টীম
সর্বশেষ সংশোধন করা : 3/4/2024