অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotics) কয়েকধরণের জৈব-রাসায়নিক ঔষধ যা অণুজীবদের (বিশেষ করে ব্যাক্টেরিয়া) নাশ করে বা বৃদ্ধিরোধ করে। সাধারানতঃ এক এক অ্যান্টিবায়োটিক এক এক ধরণের অণুজীব তৈরি করে ও অন্যান্য অণুজীবের বিরুদ্ধে কাজ করে। বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়া (Bacteria) ও ছত্রাক(Fungi) অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে। "অ্যান্টিবায়োটিক" সাধারণভাবে ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাবহার হয়, ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না। তবে অ্যান্টিবায়োটিক হল আরও বড় জীবাণু-নাশক শ্রেণীর সদস্য যার মধ্যে আছে নানা প্রকার অ্যান্টি-ভাইরাল (ভাইরাস-নাশক), অ্যান্টি-ফাঙ্গাল (ছত্রাক-নাশক) ইত্যাদি। প্রাকৃতিতেও বহু জীবাণু-নাশক আছে যাদের অনেককেই এখনও ঔষধ হিসাবে পরিক্ষা করে দেখা হয়নি, যেমন ব্যাক্টেরিওসিন (Bacteriocin)- ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা নিসৃত কাছাকাছি ধরণের ব্যাক্টেরিয়া-ঘাতক প্রোটিন টক্সিন (বিষ)। সাধারণভাবে অ্যান্টিবায়োটিক শব্দটি ক্ষুদ্র জৈব-রাসায়নিক পদার্থ বোঝায়, বৃহত প্রোটিন নয় বা অজৈব-রাসায়নিক অণু নয়, (যেমন আর্সেনিক)
প্রাকৃতিক উপাদানের যে রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা আছে, তা আন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের বহু পূর্বে মানুষের জানা ছিল। শতবর্ষ পূর্বে চীনে সয়াবিনের ছত্রাক(Mould) আক্রান্ত ছানা (Moldy Soybean Curd) বিভিন্ন ফোঁড়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত। চীনারা পায়ের ক্ষত সারাবার জন্য ছত্রাক Mould আবৃত পাদুকা (স্যান্ডল) পরত। ১৮৮১ সালে ব্রিটিশ অণুজীব বিজ্ঞানী জন টিন্ডাল (John Tyndall) ছত্রাকের জীবাণু প্রতিরোধী ভূমিকা লক্ষ্য করেন।
লুই পাস্তুর এবং জোবার্ট লক্ষ্য করেণ কিছু অণুজীবের উপস্থিতিতে প্রস্রাবে আন্থ্রাক্স ব্যাসিলি (Anthrax) জন্মাতে পারেনা। ১৯০১ সালে এমারিখ (Emmerich) এবং লও (Low) দেখেন যে আন্থ্রাক্স ব্যাসিলি ( Anthrax bacili) আক্রমণ থেকে খরগোশকে বাঁচানো সম্ভব যদি সিউডোমোনাস এরুজিনোসা Pseudomonas aeruginosa নামক ব্যাক্টেরিয়ার তরল আবাদ (Liquid culture) খরগোশের দেহে প্রবেশ (Inject) করানো যায়। তাঁরা মনে করেণ ব্যাক্টেরিয়াটি কোনো উৎসেচক (enzyme)তৈরি করেছে যা জীবাণুর আক্রমণ থেকে খরগোশকে রক্ষা করছে। তাঁরা এই পদার্থের নাম দেন পাইওসায়ানেজ (Pyocyanase)। ১৯২০ সালে গার্থা ও দাথ কিছু গবেষণা করেন এই জাতীয় জীবাণু নাশক তৈরি করতে। তাঁরা অ্যাকটিনোমাইসিটিস (Actinomycetes) দ্বারা প্রস্তুত একধরনের রাসায়নিক পদার্থ খুজে পান যার জীবাণুনাশী ক্ষমতা আছে। তাঁরা এর নাম দেন অ্যাকটিনোমাইসিন। কিন্তু কোনো রোগের প্রতিরোধে এই পদার্থ পরবর্তিতে ব্যবহৃত হয় নাই। এই জাতীয় আবিস্কারের পরও ১৯২৯ সালের আগে অ্যান্টিবায়োটিক এর যুগ শুরু হয় নাই। ১৯২৭ সালে স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (Alexander Fleming) প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন।
প্রথম আন্টিবায়োটিক ১৯২৭ লন্ডনের সেন্ট মেরি হাসপাতালে কর্মরত অণুজীব বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্লেমিং আবিষ্কার করেণ। ফ্লেমিং তার এক পরীক্ষার (Experiment) সময় লক্ষ্য করেণ জমাট আবাদ মাধ্যমে (Solid culture medium) ছত্রাকের উপস্থিতিতে স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস Staphylococcus aureus নামক ব্যাক্টেরিয়া জন্মাতে পারেনা। আবাদ মাধ্যমে ছত্রাকের উপস্থিতি কাম্য ছিল না, আসলে পরীক্ষাকালীন কোনো অজানা ত্রুটির কারণে ছত্রাক আবাদ মাধ্যমে চলে এসে ছিল। ফ্লেমিং তখন ঐ ছত্রাকের প্রজাতি চিহ্নিত করতে ও তার জীবাণু নাশক বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করতের আগ্রহী হন। ছত্রাকটি ছিল পেনিসিলিয়াম (এখন জানা গেছে পেনিসিলিয়াম ক্রাইসোজেনাম Penicillium chrysogenum প্রজাতির)। ফলে ফ্লেমিং পেনিসিলিয়াম দ্বারা নিসৃত ঐ পদার্থের নাম দেন পেনিসিলিন (Penicillin)। পেনিসিলিয়াম একা নয়, অন্য আর এক প্রকার ছত্রাক প্রজাতি যেমন অ্যাস্পারজিলাস-ও (Aspergillus) পেনিসিলিন তৈরি করতে পারে।
১৯৪১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম পেনিসিলিন মানুষের দেহে প্রয়োগ হয়। অক্সফোর্ডের একজন পুলিশ কর্মকর্তা Staplylococcus দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। পেনিসিলিনের প্রয়োগে তার অবস্থার নাটকীয় উন্নতি ঘটে। কিন্তু পাঁচ দিন পর পেনিসিলিয়ামের সরবরাহ শেষ হয়ে গেলে তিনি আবার আক্রান্ত হয়ে পড়েন, এবং মারা যান।
১৯৪০-৪১ সালের দিকে বৃটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পেনিসিলিনের গবেষনার জন্য অর্থ বরাদ্দ কমে যায়। কিন্তু ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার আমেরিকান বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলশ্রুতিতে, রকফেলার ফাউন্ডেশন (Rockefeller Foundation)ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ডাব্লিউ ফ্লোরে (Harold W. Florey) ও এন.জি. হিটলিকে (N. G. Heatly) আমেরিকায় আমন্ত্রান জানান। ২ জুলাই ১৯৪১ সালে তারা আমেরিকায় পৌছেন এবং বিশ্ববিখ্যাত ছত্রাকবিদ চার্লস থম (Charles Thom) ও আমেরিকার কৃষি বিভাগের (U.S. Department of Agriculture) সাথে আলোচনা করেন। খুব দ্রুতই আমেরিকার কৃষি বিভাগের উত্তর অঞ্চলের গবেষণাগারে তাদের কাজ শুরু হয়। গবেষনাগারটি ছিল ইলিনয়ের (Illiniois) পিওরিয়াতে (Peoria)। ফ্লেমিং যে ছত্রাক পেয়েছিলেন তা ২একক/মিলিলিটার(unit/mililiter) পেনিসিলিন তৈরি করত, কিন্তু কয়েকমাসে আমেরিকাতে বিজ্ঞানীরা প্রায় ৯০০ একক/মিলিলিটার (unit/mililiter)পেনিসিলিন প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। বর্তমানে প্রায় ৫০,০০০ একক/মিলিলিটার পেনিসিলিন প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে। এই সময় অন্যান্য অনেক আন্টিবায়োটিক আবিস্কার হয়। রেনে ডিউবস (Rene Dubos) গ্রামিসিডিন (Gramicidin) ও টাইরসিডিন(Tyrocidine) আবিস্কার করেন যা গ্রাম পজিটিভ ব্যাক্টেরিয়ার (Gram Positive Bacteria) উপর কাজ করে। বর্তমানেও অনেক আন্টিবায়োটিক আবিস্কার হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু ক্লোরামফেনিকলের (Chloramphenicol) ক্লোরামফেনিকল রাসায়নিক সংশ্লেষন সম্ভব হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের ক্ষত সারাতে প্রথম পেনিসিলিনের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়। ব্রিটেন, আমেরিকার বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, ফ্লেমিং এর সেই ভুলের কারণে পাওয়া ছাতা এক "যাদু ঔষধ" তৈরে করতে থাকে যা অসংখ্য জীবন বাঁচায়। ১৯৪৫ সালে ফ্লেমিং, আর্নেস্ট চেইন, ও ফ্লোরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাদের অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার (Nobel Prize) লাভ করেন।
বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক অণুজীবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাবে কাজ করে। তার মধ্যে প্রধান প্রধান উপায় গুলো হলঃ
অনেকগুলি করে রাইবোজোম রেলগাড়ীর বগির মত একই mRNAর রেললাইনের উপর পেছন পেছন চলতে থাকে।এদের মধ্যে যেকোন একটি অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যের ফলে অবরুদ্ধ হলে তার পিছনের সব কটিও লাইন দিয়ে আটকে যাবে।
রাসায়নিক গঠনের উপর ভিত্তি করে আন্টিবায়োটিককে নানা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাগ গুলো হল,
সাধারণতঃ অণুজীবরা অন্য অণুজীবদের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় জয়লাভের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে থাকে।
বিভিন্ন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে আন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে কিছু উদাহরণ দেওয়া হল:
আন্টিবায়োটিক-রোধী (Antibiotic-resistant) ব্যাক্টেরিয়া
অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারীতা মাপা হচ্ছেঃ
* কাগজের চাকতিতে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক মাখিয়ে আবাদ মাধ্যমে রাখলে তাদের চারদিকে ব্যাক্টেরিয়ার মৃত্যু ঘটে।
*বড় ব্যাক্টেরিয়ামুক্ত বলয় মানে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকরী।
* বলয়হীন চাকতি মানে ব্যাক্টেরিয়া আন্টিবায়োটিক-রোধী।
কিছু ব্যাক্টেরিয়া কিছু আন্টিবায়োটিকের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে(Antibiotic resistant), অন্য দিকে অন্য কিছু ব্যাক্টেরিয়া ঐ একই আন্টিবায়োটিক দ্বারা আক্রান্ত (Antiobiotic sensitive)হয়। এমনকি কিছু ব্যাক্টেরিয়া যে কিনা একটিআন্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, সেও পরিব্যাক্তি বা মিউটেশনের (Mutation) মাধ্যমে এমন সব বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে যার ফলে ব্যাক্টেরিয়াটি ঐ আন্টিবায়োটিক রোধী হয়ে পরতে পারে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যাক্টেরিয়া আন্টিবায়োটিক রোধী হয়ে উঠতে পারে; যেমনঃ
যে কোনো ব্যাক্টেরিয়ার পপুলেশনে একটি মাত্র ব্যাক্টেরিয়ার পরিব্যাক্তির বা মিউটেশনের ফলে ঐ ব্যাক্টেরিয়ার আন্টিবায়োটিক-রোধী বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব হতে পারে। এই মিউটেশনের প্রাথমিক হার খুব কম; প্রায় একটি মিউটেশন ঘটে প্রতি কয়েক লক্ষ কোষে। তবে একটি ব্যাক্টেরিয়ার আন্টিবায়োটিক-রোধী হবার সম্ভাব্যতা অনেক অংশে বেড়ে যায় যখন কোনো আন্টিবায়োটিক-রোধী ব্যাক্টেরিয়া থেকে জিন (Gene) গ্রহণ করে। কিছু কিছু ব্যাক্টেরিয়াতে তার নিজ ক্রোমসোমস্থ ডিএন এর বাইরে আরও কিছু, বংশগতির উপাদান(Genetic Material); এদের কে বলা হয় প্লাজমিড (Plasmid)। সাধারণত, আন্টিবায়োটিক-রোধী জিন গুলো এই সব প্লাজমিড বহন করে। একটি ব্যাক্টেরিয়া এই প্লাজমিড বা প্লাজমিড এর প্রতিলিপি অন্য ব্যাক্টেরিয়ায় স্থানান্তর করতে পারে। যে পদ্ধতিতে ব্যাক্টেরিয়া এই কাজটি করে তাকে বলা হয় কনজুগেশন (Conjugation)। তাছাড়া প্রায়ই ব্যাক্টেরিয়ার ক্রোমোসোমে বা প্লাজমিডে ট্রান্সপোসন (Transposon) নামে এক বিশেষ অংশ থাকে, যা কিনা আন্টিবায়টিক-রোধী জিন (Gene) বহন করে। ট্রান্সপোসন এক ক্রোমোসোম থেকে অন্য ক্রোমোসোমে, ক্রোমোসোম থেকে প্লাজমিডে যেতে পারে। যার ফলে আন্টিবায়োটিক-রোধী জিনের বা তার প্রতিলিপির স্থানান্তর ঘটে।
বিশ্বের অনুন্নত অঞ্চলে আন্টিবায়োটিকের সবচেয়ে অপব্যবহার ঘটে। এই সব দেশে বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে দক্ষ লোকের অভাবে আন্টিবায়োটিক প্রায় সর্বত্রই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করা হয়। পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই সাধারণ মাথা ব্যাথা, পেটের ব্যাথা, জ্বর ইত্যাদির জন্য আন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তাররা আন্টিবায়োটিক খেতে বলার সময়, ঐ আন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রোগির শরীরের ব্যাক্টেরিয়া আগেই প্রতিরোধী হয়ে গেছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয় না, আবার অনেক সময় রোগের শুরুতেই আন্টিবায়োটিক গ্রহণের উপদেশ দেওয়া হয়, কিন্তু হয়ত আন্টিবায়োটিক ছাড়া রোগ নিরাময় সম্ভব ছিল। এসব কারণই আন্টিবায়োটিক-রোধী ব্যাক্টেরিয়ার টিকে থাকার সম্ভবনা বাড়িয়ে দেয়।
উন্নত বিশ্বেও এই সমস্যা বিদ্যমান। আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র (Center For Diseases Control) সি.ডি.সির এক জরিপে দেখা গেছে, সেখানে ডাক্তাদের আন্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপসনের কানের সংক্রমনের জন্য ৩০%, সাধারাণ ঠান্ডার জন্য ১০০%, গলা ব্যাথার জন্য ৫০% প্রেসক্রিপসন অপ্রয়োজনীয়। তাছাড়া যারা হাসপাতালে কাজ করে তাদের মধ্যে সাধারণত আন্টিবায়োটিক-রোধী ব্যাক্টেরিয়া উপস্থিতি থাকে বেশি।
সূত্র: উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020