ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ দেবের সহধর্মিনী মা সারদা সূর্যোদয়ের আগে দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গাস্নান করে দিন শুরু করতেন। মা সারদা যখন ছোটবেলায় জয়রামবাটিতে থাকতেন তখনও তিনি মাঝে মাঝে তার দেশের ‘আমোদর নদে’ স্নান করতে যেতেন। পরবর্তীকালে দক্ষিণেশ্বরে থাকাকালীনও মায়ের গঙ্গাস্নান বড় প্রিয় ছিল। পূজা পার্বন থেকে শুরু করে বিয়ে প্রভৃতি বিভিন্ন মঙ্গলানুষ্ঠানে স্নানের গুরুত্ব যে কতখানি তার উদাহরণ সমস্ত ধর্মীয় গ্রন্থে পাওয়া যায়। চরম সংহিতায় বলা হয়েছে স্নান হল পবিত্র এবং আয়ুবর্ধক, ক্লান্তি নাশক, বলবর্ধক এবং বিশেষ বিশেষ রোগ প্রতিষেধকারী। এই রেফারেন্স নিয়েই তৈরি হয়েছে অত্যাধুনিক ‘স্পা’ যা একই সঙ্গে শরীর ও মনকে চনমনে করে তোলে।
জল বা জলীয় পদার্থ দ্বারা দেহকে পরিষ্কার করাই স্নান। এই স্নান সাধারণত দু’ ধরনের হতে পারে। ধারা স্নান (অর্থাৎ ঝরনা বা শাওয়ার) এবং অবগাহন স্নান (অর্থাৎ বাথটাব বা নদী-পুকুর প্রভৃতিতে)। এছাড়া রয়েছে সূর্যস্নান বা আতপ স্নান। প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিপত্রে দিনে তিনবার স্নানের বিধান আছে। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতায় পাবলিক বাথ হাউস বা সাধারণ স্নানাগারের উল্লেখ আছে। রোমান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে দেখা গেছে সে সময় স্নানাগারে প্রণালী দ্বারা জল সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। এই দুই সভ্যতায় দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দে যে স্নানের অভ্যাস ছিল তার প্রমাণ মেলে। আর ‘ইউরেকা’ শব্দটা বললেই মনে পড়ে যায় বাথটবে স্নান করতে করতে বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের সেই বিখ্যাত এবং যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা। আরব্যরজনীতে তখনকার দিনের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের স্নান বিলাসের বিবরণ আছে। আর যারা নিম্নবিত্তের মানুষ তাদের জন্য নগরে থাকত সামান্য দক্ষিণার বিনিময়ে সাধারণ স্নানাগারের পরিষেবা। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব পড়ার আগে জাপানে খোলা জায়গায় স্নানের রীতি ছিল। পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে ঘেরা স্থানে স্নানের রীতি চালু হয়। উষ্ণ জলে স্নান জাপানে খুবই জনপ্রিয়। তাদের মতে এটি আরামদায়ক তো বটেই সেই মাংস পেশীর ক্লান্তি দূর করতে সহায়ক। এছাড়া স্নানের আগে নানা ভেষজ ও সাবান দ্বারা গাত্র পরিমার্জন করেন। অন্যদিকে প্রায় পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয়দের মনে ধারণা ছিল যে স্নান করলে রোমকূপের মধ্যে দিয়ে দেহে রোগ জীবাণু প্রবেশ করে। এবং সেই কারণে তারা স্নান করতেন না। স্পেনের রানি ইসাবেল জীবনে মাত্র দু’বার স্নান করেন। যেদিন তার জন্ম হয় এবং দ্বিতীয় এবং শেষবার তার বিয়ের দিন। রাজা চতুর্দশ লুইও সারা জীবনে মাত্র দুবার স্নান করেছেন।
পরিচ্ছন্নতা এবং সৌন্দর্য চর্চা এই দুটি শব্দ স্নানের প্রসঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। বহু বছর ধরেই স্নানের নানা উপকরণ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। নানা ধরনের তেল বডিওয়াশ, হেয়ারওয়াশ, স্ক্রাব মানুষের চাহিদা অনুসারে এবং বিভিন্ন বয়সের উপযোগী করে তৈরি করা হচ্ছে। এর মধ্যে নবতম সংযোজন হল মেডিকেটেড সাবান ও শ্যাম্পু— যা পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে রোগ নিরাময়ও করে থাকে। তবে স্নান কবার করা উচিত এবং তা ঠান্ডা জলে না গরম জলে এই নিয়ে নানা মতামত শোনা যায়। তবে একটা জায়গায় সবাই একমত যে নিজেকে রোগমুক্ত এবং তরতাজা রাখতে স্নানের জুড়ি নেই। প্রাচীনকালের রাজা ও রানিদের স্নান বিলাসের কাহিনি আজও আমাদের অবাক করে। শোনা যায় যে রানি ক্লিয়োপ্রেটা নাকি ত্বকের ঔজ্জ্বল্য রক্ষার জন্য গাধার দুধ দিয়ে স্নান করতেন। এছাড়া প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে রানি ও রাজকন্যাদের স্নানের জলে চন্দন, কেশর, গোলাপ জল ও নানা সুগন্ধীদ্রব্য ব্যবহার করার প্রচলন ছিল।
ভারতীয়রা সাধারণত দৈনিক একবার করে স্নান করে থাকেন। আমেরিকা, স্পেন, ইটালি, অস্ট্রেলিয়া এবং ফ্রান্সের অধিবাসীরাও সপ্তাহে প্রতিদিন স্নানাভ্যাস মেনে চলেন। ব্রাজিল, কলম্বিয়া প্রভৃতি দেশের নাগরিকরা সপ্তাহে দশ থেকে বারো বার পর্যন্ত স্নান করে থাকে। অন্যদিকে চীন, জাপান, ইংল্যান্ডে সপ্তাহে পাঁচবারের বেশি স্নান করতে দেখা যায় না।
১) বাথটবে বেশ খানিকক্ষণ স্নান করলে দেহে রক্ত চলাচল ভালো হয় এবং শরীরের কোষ সমূহের পোষণ হয়। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় এই ধরনের স্নান খুবই উপকারী। শীতকালে হালকা গরমজলে এবং গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিক তাপমাত্রার জলে স্নান করলে হাইপার টেনশন কমে।
২) মাংসপেশীর ক্লান্তি দূর করতে ঈষদুষ্ণ জলে স্নান দারুণ কাজ করে। পেশীর ফ্লেক্সিবিলিটি এবং ইলস্টিসিটি ফিরিয়ে আনতে স্নান ভীষণ জরুরি।
৩) অবগাহন স্নান রক্ত সংবাহন তথা হার্ট ফাংশান উন্নত করে।
৪) একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ মিনিট বাথটবে হালকা গরমজলে স্নান ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
৫) ঠান্ডা জলে স্নান অবসাদ বা ডিপ্রেশান দূর করতে সাহায্য করে। শীতল জলের স্পর্শ স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপ্ত করে। এর ফলে রক্তে বিটা এন্ডরফিন এবং নর অ্যাড্রিনালিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যার ফলে ডিপ্রেশান কমে। এছাড়া শীতল জলের সংস্পর্শে মস্তিষ্ক সজাগ হয় এবং অবসাদজনিত প্রভাব কেটে যায়।
৬) শীতল জলে স্নান করলে রক্ত ও লসীকা সংবাহন উন্নত হয়, অ্যান্টিবডির উৎপাদন বাড়ে যা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। তবে খুব ঠান্ডায় হালকা গরম জলে স্নান করাই ভালো। কারণ শীতকালে ঠান্ডা জলে স্নান অনেকেরই সহ্য হয় না।
৭) একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করার ফলে স্ট্রেস এবং টেনশন কমে যায়।
৮) কোল্ড শাওয়ার দেহে টেস্টোস্টেরোনের ক্ষরণ বাড়াতে সাহায্য করে। অনেক সময় দীর্ঘদিন গরম জলে স্নানের ফলে মেল ইনফার্টিলিটি হতে দেখা যায়।
৯) রাত্রে স্নান করলে পর্যাপ্ত ঘুম হয়। ইনসমনিয়ার সমস্যায় রাত্রে শোবার আগে স্নান করা খুবই উপকারী।
১০) যারা বেশি মাত্রায় বডি স্প্রে, পাউডার এবং পারফিউম ব্যবহার করে তাদের নিয়মিত স্নান করা খুবই জরুরি।
১১) যাদের অতিরিক্ত ঘাম বের হয় তারা অবশ্যই নিয়মিত স্নান করবেন। তা না হলে শুধুমাত্র দামি সুগন্ধীর ব্যবহার গায়ের দুর্গন্ত তাড়াতে পারবে না।
১২) স্নান ত্বকের দ্বারা নিঃসৃত টক্সিনকে দূর করে।
১৩) শাওয়ারে স্নান করলে ফুসফুসের রিফ্লেক্স অ্যাকশন বাড়ে। যার ফলে ফুসফুসে বিশুদ্ধ বায়ু সহজে প্রবেশ করে।
১৪) মাথা ধরা ও মাথা ব্যথার সমস্যায় স্নান উপকারী।
১৫) স্নান ত্বকের আদ্রতা, কোমলতা বজায় রাখে ত্বকের রোগ প্রতিরোধ করে।
১৬) ওবেসিটির সমস্যায় নিয়মিত ২০ থেকে ৩০ মিনিট হট বাথ উপকারী। এতে ওজন কমে। স্নান এনার্জি বাড়াতে সাহায্য করে।
স্নান আরামদায়ক এবং দেহের পরিচ্ছন্নতা প্রদানকারী আবার বিভিন্ন ভেষজ সহযোগে নানা রোগ উপশমেও সাহায্য করে।
১) স্নানের জলে দুধ মেশালে ত্বক নরম এবং উজ্জ্বল হয়। দুধ ত্বককে পুষ্টি দেয়।
২) সারাদিন ফ্রেশ থাকার জন্য এবং ঘামের দুর্গন্ধ এড়াতে এক চামচ গোলাপজল স্নানের জলে মেশাতে হবে।
৩) রাইস স্টার্চ মেশানো জলে স্নান করলে ত্বক নরম হয় সহজে বলিরেখা পড়ে না।
৪) তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যায় স্নানের জলে দু’চামচ লেবুর রস মেশাতে হবে।
৫) জুঁই ফুলের পাপড়ির নির্যাস মেশানো স্নানের জল গরমকালের জন্য আদর্শ।
৬) বর্ষাকালের জীবাণু সংক্রমণ দূরে রাখতে নিম এবং ক্যাম্ফর পাউডার মেশানো জলে স্নান করা যেতে পারে।
৭) যারা জয়েন্ট পেন এ ভুগছেন স্নানের আগে রাস্না, বচ ও আদার পেস্ট মাখুন। এরপর উষ্ণ জলে স্নান করুন।
৮) একইভাবে অ্যালার্জির সমস্যায় হলুদ এবং মঞ্জিষ্ঠা ব্যবহার করতে হবে।
৯) মাত্র দু’ ফোটা ইউক্যালিপটাস অয়েল বাথটবের উষ্ণ জলে মিশিয়ে নিলে মাসল পেন এবং জয়েন্ট পেন কম থাকে।
১০) সর্দি-হাঁচি-কাশিতে গরম জলে সামান্য পিপারমিন্ট বা আদার রস মিশিয়ে বাথটবে ১০মিনিট স্নান করুন।
স্নানের জন্য কোনটা বেশি ভালো গরম জল না ঠান্ডা জল সেই নিয়ে অকারণে চিন্তিত হবার প্রয়োজন নেই, মনে রাখা দরকার—
১) প্রচণ্ড গরমে ঠান্ডা জলে স্নান করা যেতে পারে।
২) তবে নিউবর্ণ বেবিদের জন্য কনকনে ঠান্ডা জল কখনোই নয়। বাচ্চার আম্বিলিকাল কর্ড শুকিয়ে যাবার পর নিয়মিত পাঁচ মিনিট স্নান জরুরি। সপ্তাহে দুবার ভালো বডি ওয়াশ এবং হেয়ার ওয়াশ শিশুর ত্বককে সংক্রমণ থেকে বাঁচায়।
৩) ভালো বাথ সল্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে স্নানের পর রিফ্রেশিং, ফিলিংস হয়।
৪) যারা দীর্ঘক্ষণ বাথটবে গরম জলে স্নান করেন তাদের ডিহাইড্রেশানের সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে ফ্রুটজুস বা অন্য কোনও নরম পানীয় পান করলে ভালো লাগবে।
৫) বাথ সল্ট বা ডেড সী সল্ট গরম জলে মেশালে একটু বেশি সময় ধরে স্নান করতে হবে। উষ্ণ জল ত্বকের রোমকূপ খুলে দেয় আর বাথ সল্ট ইউথফুলনেস এবং রিজুভিনেশানে সাহায্য করে। তাই অন্তত ২০ মিনিট স্নান করা দরকার।
৬) দিনের শুরুতে অবশ্যই স্নান করা উচিত। এতে এনার্জি বাড়ে।
৭) একইভাবেদিনের শেষে স্নান করা দরকার। এতে সারা দিনের স্ট্রেস রিলিভ হয়।
৮) অ্যাসমা, আর্থরাইটিসের রোগীদেরজন্য ঈষদুষ্ণ জলে স্নান নিরাপদ।
৯) কনস্টিপেশন সারাতে বাথটবে ঠান্ডা জলে স্নান করা যেতে পারে।
১০) ঠান্ডা অথবা গরম যাতে স্বচ্ছ্যন্দ বোধ হয় সেই জলই স্নানের জন্য ভালো আর পরিচ্ছন্নতার জন্য স্নানের থেকে ভালো আর কিছুই নেই।
সুত্রঃ বর্তমান থেকে সংকলিত
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/22/2020