রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিভিন্ন মঞ্চে সম্প্রতি ‘এক স্বাস্থ্যভাবনা’ বা ‘ওয়ান হেল্থ কনসেপ্ট’ গুরুত্ব পাচ্ছে ও আলোচিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লু এইচ ও, সংক্ষেপে ‘হু’) এবং বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফ এ ও, সংক্ষেপে ‘ফাও’) এই ঐকমত্যে পৌঁছেছে যে, সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যের ভাবনা সামগ্রিকভাবে একটিই হওয়া উচিত, যেহেতু প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণী, এককথায় প্রতিটি জীবই প্রকৃতি নামক একটি পরিবারের সদস্য, তাই একের সুস্থাস্থ্য অপরের ওপর ভীষণভাবেই নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক দূষণ বা বিপর্যয় যেমন মানুষের অস্বাস্থ্যের কারণ হতে পারে, তেমনি প্রাণী–অপুষ্টি ও তার রোগব্যাধি মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে পারে। প্রাণী ও মানুষের আন্তঃসম্পর্ক এতটাই নিবিড় যে, মানুষের প্রায় ৭০ শতাংশ সংক্রামক রোগই কোনও না কোনওভাবে প্রাণীদের থেকে চলে আসছে— এমনটাই জানা গেছে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায়। তাই মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য– সম্পর্কিত বিষয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই দুই সংস্থা নড়েচড়ে বসেছে। বিশ্ব জুড়ে কর্মসূচি নিচ্ছে কীভাবে স্বাস্থ্যবিষয়ক চ্যালেঞ্জগুলোকে যৌথভাবে মোকাবিলা করা যায়। এই পটভূমিকায় দুটি জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে তারা একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটি হল মানুষ ও প্রাণীতে ব্যবহার্য অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের প্রতিরোধ তৈরি হওয়া এবং অপরটি হল সার্স, ইবোলা, জিকা, হেনিপার মতো প্রাণীবাহিত নতুন ধরনের ভাইরাসঘটিত রোগের উৎপত্তি।
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষের সঙ্গে প্রাণীর সখ্যের প্রমাণ আমরা পেয়েছি। বিভিন্ন সময়ে প্রাণীকুল যে কেবলমাত্র চিত্ত বিনোদন করেছে, তাই নয়, তার উৎপাদিত দেহজ আকর তুলে দিয়েছে মানুষের পুষ্টি, রসনা ও ব্যবহার্য সামগ্রীর উপাদান হিসেবে। দুধ, ডিম, মাংস, উল, চামড়া, হাড় এমনকি কায়িকশ্রম আমরা প্রাণীদের কাছ থেকে ‘আদায়’ করেছি আমাদের মতো করে। পারস্পরিক এই দেওয়া–নেওয়ার সম্পর্কের মাঝে আবেগ–এর পরিমাণ নিতান্ত কম হলেও তা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। গৃহপালিত প্রাণী তাই কোনও কোনও সময়ে পারিবারিক সদস্যও হয়ে উঠেছে।
এই সখ্যের মাঝে আবার প্রবেশ করেছে কিছু রোগজীবাণুর অনভিপ্রেত উপস্থিতি। আর তারাই এই সখ্যতাকে কোনও কোনও সময়ে বিষময় করে তুলেছে। প্রাণী থেকে মানুষে ও মানুষ থেকে প্রাণীতে এরা রোগের চলনকে ত্বরান্বিত করে। পরিভাষায়, এদের আমরা জুনোটিক রোগ বা ‘জুনোসিস’ বলি। এই ধরনের রোগ তৈরি করে কিছু জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া), ছত্রাক (ফাঙ্গাস), বীষাণু (ভাইরাস) ও পরজীবী (প্যারাসাইট)। প্রতিষ্ঠিত ও উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জুনোটিক রোগ হল— জলাতঙ্ক, যক্ষ্মা, অ্যানথ্রাক্স, ব্রুসেলোসিস, হাইডাটিডোমিক প্রভৃতি। এদের মধ্যে জলাতঙ্ক ও যক্ষ্মা আমাদের দেশের নিরিখে অবশ্যই প্রথম সারিতে বলা যায়।
বর্তমানে মানুষের যক্ষ্মারোগের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীদেহে যক্ষ্মা, পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। যক্ষ্মা একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত ‘জুনোটিক’ রোগ। মানুষ ও গবাদিপ্রাণীর যক্ষ্মা শ্বাস–প্রশ্বাস ও খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়। মুরগির ক্ষেত্রে সেটা হয় জল ও খাদ্যের মাধ্যমে। মানুষের মতো প্রাণীদের যক্ষ্মারোগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফুসফুস আক্রান্ত হয়। তবে ফুসফুসবহির্ভূত যক্ষ্মা অন্ত্রে, বৃক্কে, পাকস্থলীতে, অস্থিতে, জননঅঙ্গে, স্নায়ুতন্ত্রে, এমনকি ত্বকেও হতে পারে। এক্ষেত্রে জীবাণুগুলো রক্তের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, বাসা বাঁধে ও বংশবৃদ্ধি করে। ছাগল ও ভেড়ার যক্ষ্মা খুবই কম দেখা যায়। কুকুর ও বিড়ালের যক্ষ্মার হারও ভয়াবহ হয়। অন্যদিকে, মানুষ ও গবাদিপশুর যক্ষ্মা আজ এক ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সমীক্ষায় জানা গেছে, বিশ্বের এক– তৃতীয়াংশ মানুষ ও গবাদিপ্রাণী আজ মাইকোব্যাকটেরিয়াম ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত। রোগলক্ষণ সবার না দেখা গেলেও তারা এই ব্যাকটেরিয়া ছড়াতে সাহায্য করছে। মানুষের মতো গবাদিপ্রাণীর যক্ষ্মায় মূলত কম তাপমাত্রার জ্বর হতে দেখা যায়। শ্বাসকষ্ট, শুকনো কাশি, রোগা হয়ে যাওয়া, গাভীর ক্ষেত্রে কম দুধ উৎপাদন হওয়া চোখে পড়ে। যক্ষ্মা একটি ক্রনিক ক্ষয়রোগ। এ যেন ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। মানুষ ও প্রাণীর দেহের মধ্যে রোগ বিস্তার বেশ কয়েকমাসব্যাপী হয়। এটা ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত হতে পারে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেটা এক বছরও ছাড়িয়ে যায়।
র্যাবিস বা জলাতঙ্ক একটা ভাইরাসঘটিত রোগ। এই রোগ কুকুর, শিয়াল প্রভৃতি প্রাণীর লালারসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরা যখন মানুষকে কামড়ায়, মানুষও এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই ভাইরাস স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। রোগের শেষ পর্যায়ে আলো ও জল দেখলেই কুকুর বা আক্রান্ত প্রাণীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আক্রান্ত মানুষের ক্ষেত্রে এই আলো ও জল সংক্রান্ত ভীতির দশাটাই বেশি নজরে পড়ে। রোগী নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। পাগলা কুকুর কোনও মানুষকে কামড়ালে, সেই ক্ষতস্থান সাবানজল দিয়ে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ধুতে হবে। জায়গাটিতে টিংচার অফ আয়োডিন লাগাতে হবে। এটা প্রাথমিক চিকিৎসা। এরপর ডাক্তারবাবুর পরামর্শমতো টিকা নিতে হবে।
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং–এর পেনিসিলিন আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পথচলা শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধে আহত সৈনিকদের জীবাণু সংক্রমণজনিত নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে বিশ্বের দরবারে এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে অনেকটাই। পরবর্তীকালে, জীবাণুঘটিত রোগের চিকিৎসায় এর ওপর নির্ভরতা বেড়েছে বই কমেনি। নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার ও ওষুধ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোর দৌলতে তা বাজারজাত হওয়ার সুবাদে এর ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। আর সঙ্গে সঙ্গে এদের ব্যবহারের খারাপ দিকগুলোও সামনে এসেছে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের অন্যতম খারাপ দিক হল অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী নতুন নতুন প্রজাতির জীবাণুর উদ্ভব। জীবাণুরা তাদের জিনের পরিবর্তন করে বিশেষ কিছু ‘স্ট্রেন’ তৈরি করে, যারা শরীরের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকলাপকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে সক্ষম। জীবাণুদের এই অ্যান্টিবায়োটিক ‘রেজিস্ট্যান্স’–এর ক্ষমতা বিজ্ঞানীদের বেশ ভাবাচ্ছে। চেষ্টা চলছে, কীভাবে এই রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার উদ্ভদ ঠেকানো যায়। যেমনটা দেখছি, মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট মাইকোব্যাকটেয়ামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণায়। প্রাণী ও মানুষে অ্যান্টিবায়োটিকের অযাচিত ও যথেচ্ছ ব্যবহার আজ সুবিদিত। সাধারণ সর্দি–জ্বর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাইরাসঘটিত রোগে এর অযাচিত ব্যবহার এবং ডোজ ও কোর্সের বালাই না করে এর অপরিকল্পিত ব্যবহার রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তৈরির পথকে সুগম করেছে। অধিক উৎপাদন তথা মুনাফার আশায় খামারিরা মাছ, চিংড়ি, ভোজ্য–প্রাণী ও মুরগির খাদ্যে কম ডোজে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন, যা এই সমস্যাকে অনেক বেশি জটিল করে তুলেছে। মুশকিল হচ্ছে, এই গুপ্তভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সঠিক হিসেব বিশেষজ্ঞদের জানা নেই। ফলে সমস্যার গভীরতা নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা।
মানুষ ও প্রাণীর নিবিড় আন্তঃসম্পর্ক জন্ম দিচ্ছে নতুন নানা সমস্যার। ফলাহারী বাদুড় খেজুরের রস পছন্দ করে জানা থাকলেও জানা ছিল না, তারাই হেনিপা ভাইরাসের স্বাভাবিক বাহক। মুরগি, শূকর, ইঁদুর ও বাঁদর প্রজাতির প্রাণীরা যে মানুষে নতুন ভাইরাসঘটিত রোগ তৈরিতে বেশ পটু, তা জানা গেছে সম্প্রতিই। আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর লাগামহীন প্রাণী চলাচল এই সমস্যার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
অবস্থানগত কারণে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এই সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের কাছে অন্যতম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে মাছ ও মুরগির নিবিড় চাষ বেড়ে যাওয়া এবং অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের আন্তর্জাতিক সীমানা ছুঁয়ে থাকা এই রাজ্য তাই আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে অবস্থান করছে, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই চিন্তার প্রতিফলন ঘটল সম্প্রতি (২০–২২ মে) কলকাতায় অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায়। ‘ফাও’–এর উদ্যোগে আয়োজিত এই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত জাতীয় স্তরের গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন বিজ্ঞানী, নির্দেশক (পরিচালক) তথা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা। সিদ্ধান্ত হয়, এই রাজ্যে অবস্থিত মানুষ ও প্রাণী–স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে এই বিষয়ে তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি গবেষণা প্রকল্প হাতে নেবে এবং এই সমস্যা সমাধানের দিশা নির্দেশ করবে। এতে রাজ্যের গবেষকদের একাধারে গুরুত্ব ও দায়িত্ব যে বাড়ল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক সহযোগী অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়, বেলগাছিয়া, কলকাতা
সূত্র: আজকাল
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020