প্রচলিত ধারণা: শিশুশ্রমের সমস্যার কোনও সমাধান সম্ভব নয়। দরিদ্র বাবা-মা তাঁদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চান না, বরং তাঁরা তাদের কাজে পাঠান কিছু রোজগার করে পরিবারে দেওয়ার জন্য। এ সমস্ত বাচ্চার কাজ করা ছাড়া অন্য কিছু উপায় থাকে না। কারণ তা না করলে তাদের পরিবার উপবাসে থাকবে। এ ছাড়াও কাজ করলে তারা তাদের ভবিষ্যতের রোজগারের জন্য কিছু দক্ষতা অর্জন করে।
বাস্তব: এ সমস্ত কথা যখন আমরা শুনব, তখন আমরা নিজেদেরই প্রশ্ন করব, যে কেন কিছু গরিব মানুষ সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তাদের বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাচ্ছে এবং কেন কিছু গরিব মানুষ পাঠাচ্ছে না। সত্যটা এই যে যারা নিজেদের সুবিধার জন্য একের পর এক বাচ্চা জন্ম দেয়, দারিদ্র্য তাদের কাছে একটা অজুহাত মাত্র। কিছু সামাজিক কারণ শিশুশ্রমিক তৈরি করে। শ্রেণি বৈষম্যের শিকার হওয়ায় সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা সব সুযোগ পান না। আমরা জানি শিশু সহ পরিবারের সকলে কাজ করলেও পরিবারে অনাহার থাকে। অন্যায্য সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিন্যাসই এর কারণ।
প্রত্যেক বাবা-মা চান তাঁদের সন্তানরা লেখাপড়া শিখুক। অন্তত প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। অশিক্ষিত বাবা-মায়ের জন্য স্কুলে ভর্তি করার পদ্ধতিটি অত্যন্ত জটিল। বিশেষ করে প্রমাণপত্রগুলির ব্যাপার। জন্ম তারিখ, জাতের শংসাপত্র --- ইত্যাদি সব কিছু স্কুলের ভর্তির পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে বাচ্চারা বংশের প্রথম হিসাবে স্কুলে যাচ্ছে বা বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা অশিক্ষিত, সেখানে বাচ্চাদের পক্ষে পাঠক্রম কঠিন হয়ে দাঁড়ায় । সে ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা পড়াশোনায় কোনও সাহায্য করতে পারেন না। স্কুলে শাস্তি, জাত বৈষম্য এবং শৌচাগার বা খাবার জলের মতো প্রাথমিক সুযোগসুবিধার অভাব প্রভৃতির জন্যও শিশুরা স্কুলে আসা বন্ধ করে। কন্যাসন্তানের প্রতি আরও কম যত্ন নেওয়া হয়। কারণ শহর ও গ্রামাঞ্চলে শিশুদের যথাযথ ভাবে লালন করার সুযোগ অপ্রতুল এবং লিঙ্গ বৈষম্য মানুষের মনের গভীরে রয়েছে।
যে সব শিশু বাইরে কাজ করে এবং স্কুলে যায় না, তারা সারা জীবন নিরক্ষর এবং কাজের ক্ষেত্রে অদক্ষ হয়েই থাকে। কারণ শিশুরা অদক্ষ শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়াও বিশেষ কিছু বিপজ্জনক কাজে ক্ষতিকারক রাসায়নিক তরল এবং উপাদানের ব্যবহার, কাজের দীর্ঘ সময়, কাজের ধরন শিশুর স্বাস্থ্যহানি করে এবং তাদের উন্নতিতে বাধা দেয়। শিশুশ্রমিকদের অস্তিত্ব ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারভুক্ত ২১ ক অনুচ্ছেদের বিরোধী। এতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা ৬-১৪ বছর বয়সি প্রত্যেকটি শিশুর মৌলিক অধিকার।
এটা অবশ্যই মনে রাখা উচিত, এক জন শিশুশ্রমিককে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া মানে এক জন প্রাপ্তবয়স্কের কর্মসংস্থান হওয়া। ভারতবর্ষে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বেকার যারা শিশুদের স্থান অধিকার করতে পারে এবং শিশুদের জন্য একটা আনন্দপূর্ণ মুক্ত শৈশব উপহার দিতে পারে।
ভারতবর্ষে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশুশ্রমিক রয়েছে। ২০০১-এর আদমসুমারি থেকে জানা যায়, ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের মধ্যে ১.২৫ কোটি শিশু বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত। যদিও এনজিও-দের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সংখ্যাটি আরও বেশি। কারণ তারা প্রত্যন্ত গ্রামে এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে। সেখানে শ্রমিক হিসাবে বহু শিশুর নাম জনগণনা সংক্রান্ত তথ্যে নথিভুক্ত করানো হয় না।
শিশুদের কায়িক শ্রমে লাগানোর জন্য তাদের পাচার করা হয়, কেনাবেচাও করা হয়। এ ক্ষেত্রে দালালরা প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে পরিবারের কাছে ভালো মানুষ সেজে শিশুদের নিয়ে আসে এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের পাচার করে। বাংলা ও বিহার থেকে শিশুদের নিয়ে যাওয়া হয় কর্নাটক, দিল্লি এবং মুম্বইয়ে, সুতোর কাজ করানোর জন্য । তামিলনাড়ু থেকে উত্তরপ্রদেশে শিশুদের নিয়ে যাওয়া হয় মিষ্টি তৈরির জন্য এবং সুরাতে নিয়ে যাওয়া হয় রত্ন ও হিরে কাটা এবং পালিশের জন্য। এদের মধ্যে শত শত শিশু মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের বাড়িতে চাকর হিসেবে কাজ করে।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019