উত্তর দিনাজপুর জেলার এক জন লিখেছেন :
‘চাকরিতে যোগদানের জন্য বিদ্যালয়ে পৌঁছলাম, নিজের চাকরির স্থলটাকে দেখে আমি কাঁদতে বসে গিয়েছিলাম। একটি টিনের দোচালা ঘর। যার জানলা দরজাগুলি ভাঙা, গুটিকয়েক বাচ্চা স্কুলের সামনে খেলা করছে। স্কুলে এক জন মাত্র শিক্ষক সে দিন এস আই অফিসে মিটিং থাকার জন্য বিদ্যালয়ে আসতে পারেননি। হঠাৎ করে যেমন মনে হয় চার দিকে ধু ধু বালুচরে আমি একা। আসলে মনে মনে একটা স্বপ্ন ছিল, ছোট ছেলেমেয়েদের মানুষ হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দেওয়ার...। লড়াইটা নিজের সঙ্গে ছিল ... ৩ মাস পরে প্রধান শিক্ষক রিটায়ার করে গেলেন। আমি একা ... মনে মনে ঠিক করলাম যেমন করেই হোক কিছু একটা করে দেখাব।’
এই একা করে দেখানোর মানসিকতা শিক্ষকদের অনেকের মধ্যে আছে।
শিক্ষকতা পেশার গর্ব ও দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করেন, এমন শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি। তাই আমরা দেখি জলপাইগুড়ি জেলার শিক্ষক দীপংকর রায় লিখেছেন :
‘শিক্ষকতা পেশা হিসাবে বেছে নেব, এমন ভাবনা কখনওই মনে পোষণ করিনি। অথচ জীবন ও জীবিকার এই ভয়াবহ সময় যখন সম্মানজনক কোনও একটি পেশাকে বেছে নেওয়ার মতো কোনও লক্ষ্য স্থির করা যায় না বা বলা ভালো করে ওঠা যায় না, তখনই বেছে নিতে হয় যে কোনও পেশাকে। অথচ শিক্ষকতা যেমনতেমন কোনও পেশা নয়। এর পরিসর অনেক বড় ... আমি এক জন শিক্ষক, এই বোধ যখন ক্রমাগত নিজের ভিতরের সত্তাটাকে নাড়া দিতে থাকে, তখন আরও বহু বহু পেশার মধ্যেও এই পেশার এক জন হয়ে মন গর্বিত হয়ে ওঠে। জানি ... এই পেশা যেন আর সেই সামাজিক কৌলিন্যে অবস্থান করে না। তবু শিক্ষক সমাজের ভাবী নাগরিকদের মেরুদণ্ড মজবুত করার কারিগর’ এই তকমাটা তো চিরকালীন। ... আমি তো আর পাঁচ জনের মতো নই। আমি তো এক জন শিক্ষক। শিক্ষাদান আমার কাজ।’
এই আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা শুধুমাত্র নিজের নিজের কার্যক্ষেত্রেই যাতে সীমাবদ্ধ না থাকে, যাতে এটা অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারে, তেমন একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারার উপর প্রাথমিক শিক্ষার অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই সম্ভাবনা যে প্রবল তার অনেক প্রমাণ আমরা শিক্ষকদের লেখাগুলো থেকে পাচ্ছি। এই লেখাগুলোতে দুর্বলতার নানা দিক উঠে আসে, এটা যেমন ঠিক, তার চেয়েও বড় সত্য হল, সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার আলোয় পথ খোঁজার একটা আত্মবিশ্বাসী চেষ্টা। এই চেষ্টাকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতেই হবে।
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 8/29/2019